বুধবার , ১৩ নভেম্বর ২০১৯ | ৮ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
  1. article
  2. Artist
  3. কবিতা
  4. কলাম
  5. গল্প
  6. গুণীজন

প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেন

প্রতিবেদক
রুদ্র আমিন
নভেম্বর ১৩, ২০১৯ ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ

বহু প্রতিভার অধিকারী, মানব দরদী, সমাজ হিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নিকটবর্তী লাহিনী পাড়া গ্রামে বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তার সাহিত্যিক জীবন ছিল নির্লিপ্ত। রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি প্রত্যক্ষভাবে। কলমের যুদ্ধে অংশ নেন তিনি নির্ভীক সৈনিকের মত।

শৈশবে মীর মশাররফ হোসেন প্রথমে গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করেন, পরে কিছুদিন তিনি কুষ্টিয়া ইংরেজি স্কুলে এবং একবছর পদমদীর নবাব স্কুলে লেখাপড়া করেন। ফরিদপুরের পদমদী স্কুলে লেখাপড়ার সময় তিনি ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সম্ভবত: এর বেশি লেখাপড়ার সুযোগ তার ঘটেনি। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি কিছুদিন ফরিদপুরের পদমদী নবাব এস্টেটে এবং কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। পরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার জমিদারী এস্টেটে ম্যানেজারিতেই কর্ম জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটে কাজের সময়টাকেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মনে করা হয়। কারণ এখান থেকেই তিনি সামাজিক ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ‘গ্রাম্য বার্তা’ সম্পাদক হরিণাথ মজুমদার ওরফে ‘কাঙাল হরিণাথ’ তার সাহিত্য গুরু ছিলেন। তৎকালীন তিনি এই ‘গ্রাম্য বার্তা’ এবং ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা দুটিতে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তার আগে বাংলা গদ্য সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলমান সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। আধুনিক যুগে মুসলমান সাহিত্যসেবীদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন অগ্রপথিক। তার সাহিত্য কর্ম পরবর্তীকালে বহু মুসলিম সাহিত্য সাধককে সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছিল।

অতি অল্প বয়সেই তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়। তার প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নবতী’ নামক উপন্যাস ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে রচিত ও প্রকাশিত হয়। তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘আমার জীবনী’ এটি ১২ খণ্ডে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। তার ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক আত্মজীবনীমূলক, ‘উদাস পথিকের মনের কথা’ তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনা। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা সর্ববৃহৎ উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রি:) তার শ্রেষ্ঠ রচনা। মীর মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদ সিন্ধু’ সেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রায় ১২০ বছর ধরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত আসন দখল করে আছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে দামেস্কের অধিপতি এজিদের বিরোধ ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে প্রধান ঘটনা। তার এই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রি:) তাকে বাঙালি পাঠক সমাজ তথা মুসলিম বিশ্ব চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

মীর মশাররফ হোসেন বাংলা কাব্য, প্রবন্ধ উপন্যাস রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের এক নব্য সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্য রস গ্রন্থ রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এ ছাড়া উপন্যাস ‘রতœাবতী’ থেকে ‘বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী’ প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সমাজ চিত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে তার প্রকাশিত, অপ্রকাশিত ৩৫ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।

উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দূরে সরে গিয়ে সাহিত্য রচনা করতেন আপনমনে। সে সময়ের রাজনৈতিক চেতনার ফলস্বরূপ ‘মোহামেডান লিটারেরী সোসাইটি’ থেকে শুরু করে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’, ওহাবী থেকে বঙ্গভঙ্গ কোন কিছুই আলোড়িত করতে পারেনি মীর মশাররফ হোসেনকে। তার সাহিত্যিক জীবন ছিল নির্লিপ্ত। রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি প্রত্যক্ষভাবে। কলমের যুদ্ধে অংশ নেন তিনি নির্ভীক সৈনিকের মত। তার আগে পারেননি কোন মুসলমান গদ্যশিল্পী। বাঙালি মুসলমানরা কিছুতেই সরে আসতে পারছিলেন না পুঁথি সাহিত্য থেকে।

কোন কোন সমালোচক মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ জগৎনামাও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধুভাষার রূপান্তর মাত্র।’ আবার কোন সমালোচক তার সাহিত্যকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেছেন। বলেছেন, তিনি মাইকেল-বঙ্কিমের শিল্পানুভূতির উত্তরাধিকারী। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা কালচারের হিন্দুমূর্তি যে অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে তার ছিল দু’টো রূপ। একটা পন্ডিতি ধরনের। সেটা আবার নাগরিকতায় প্রভাবিত ও যুক্তিধর্মী। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল বেশি ভাবপ্রবণ, সরল এবং গ্রামীণ। দু’টো ধারাই বিদ্যমান মীর মশাররফ হোসেনের লেখায়। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রতি বিমুখ ছিলেন তিনি তাকে শাশ্বত শিল্পীর মহিমা দান করেছে মানবতার উদারবাণী ও নির্লিপ্ত সাধনা। সমালোচকের উক্তি, ‘‘মনে হয় যেন এই শিল্পী কোলাহলের নয় নিঃসঙ্গতার, সমাজের নয় জীবনের, প্রতিষ্ঠার নয় হৃদয়াসনের।’’ ড. নীলিমা ইব্রাহীমের মতে মীর মশাররফ হোসেনের বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ থেকে ছত্রিশ কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা পরিচিত নই ওর সব লেখার সাথে। কোন কোন সমালোচক বলেন, তার সব লেখা ছাপা হয়েছে কি-না তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।

বাংলা নাটকের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেনের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর নাট্যপ্রতিভার পরিচয় বহন করে বেশ কিছু নাটক। যেমন বসন্ত কুমারী, জমিদার দর্পণ এর উপায় কি ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রহসন ও গীতাভিনয় রচনা করেছেন। ভাই, ভাই, এইতো চাই, একি, ফাঁস, কাগজ, টালা প্রভৃতি তাঁর নাটক বা নাটক জাতীয় রচনা। এগুলোর মধ্যে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে বসন্ত কুমারী ও জমিদার দর্পণ নাটক দু’টি। সেই সময়কার সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যেমন বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বৃদ্ধের তরুণী ভার্ষা গ্রহণ ইত্যাদি সমস্যার প্রেক্ষাপটে রচিত ‘বসন্ত কুমারী’ নাটক। ‘বসন্ত কুমারী’ নাটকটি রচনা করেছেন কল্পনাকে আশ্রয় করে কিন্তু বাস্তবতার চিত্র এতে প্রস্ফুটিত। হিংসা, দ্বেষ, লোলুপতার জন্য যে ভয়াবহতা সৃষ্টি হয় জীবনে তারই চিত্র তুলে ধরেছেন মীর মশাররফ হোসেন। ইন্দ্রপুরের রাজা বিপত্নীক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না তার। রাজমন্ত্রী তাকে বিভ্রান্ত করলেন। রাজার ইচ্ছে ছিল যুবরাজকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অবসর নেবেন। কিন্তু কূটমন্ত্রী চিন্তা করে যুবরাজ সিংহাসনে বসলে তার স্বার্থকতা সম্ভব হবে না। কৌশলে রাজাকে সিংহাসন ত্যাগ করতে দিলেন না বরং রাজার মনকে এমনভাবে বিগলিত করলেন যা তার দ্বিতীয়বার বিয়ে করার চিন্তা মাথায় এল। সবই ছিল মন্ত্রীর কূটচাল। সে মহারাজকে বলে।

‘‘সেকি মহারাজ? বলেন কি? কিসের বয়স? আপনার চুল পাকছে? কৈ আমিতো একটিও পাকা দেখতে পাই না।’’ মন্ত্রীর প্ররোচনায় রেবতী নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন মহারাজ। নতুন রানীর প্রেমে তিনি মুগ্ধ। কিন্তু রেবতী ভালবাসতে পারে না রাজাকে। সে অবৈধ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। রাজকুমার নরেন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। প্রেম নিবেদন করে নরেন্দ্রকে। এদিকে ‘বসন্ত কুমারী’ স্বয়ংস্বর সভায় রাজকুমারকেই মাল্যদান করে। নরেন্দ্র স্ত্রীসহ দেশে ফিরলে হিংস্র হয়ে ওঠে রেবতী। তার কু-প্রস্তাব রাজকুমারের কাছে প্রত্যাখ্যাত হলে রেবতী ওর নামে নালিশ করে রাজার কাছে।

‘মহারাজ। সে বড় ভয়ানক কথা। আমি যে মুখে আনতে পারি না। আমার মরণই ভাল। পুত্রের এই কাজ। আমি না হয় বিমাতাই হলাম।’ রেবতীর মিথ্যে প্ররোচনায় নিরপরাধ পুত্রকে জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশের আদেশ দেন রাজা বসন্ত কুমারী স্বামীর সাথে সহমৃতা হলেন। রাজা পরে রেবতীর লেখা প্রেমপত্র উদ্ধার করে পড়ে সত্য উপলব্ধি করেন। কলংকিনী রেবতীর মস্তক দেহচ্যুত করেন তরবারির আঘাতে।

নাটকের প্রস্তাবনা করা হয়েছে অনেকটা সংস্কৃত নাটকের ঢঙে। কাহিনী, রীতি যাই থাক প্রাণবন্ত কল্পনার স্পর্শ আবেদন ক্ষমতায় এনে দিয়েছে দীপ্তমাধুরি। এর কাহিনী একুশ বছর আগে লেখা জিসি গুপ্তের ‘কীত্তিবিলাস’ নাটকের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে অনেকেরই বিশ্বাস। নাটকটির নামকরণ বসন্ত কুমারী হলেও রেবতীকে ঘিরে এ নাটকটি আবর্তিত। নাটকটির প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রেবতী চরিত্রের জটিলতা, লোভ, লালসা। সমাজের একটা জটিল চরিত্রের নাটকীয় বিশ্লেষণই এ নাটকের বিষয়বস্তু সেজন্য নাট্যকার এর দ্বিতীয় নামকরণ করেছেন ‘বৃদ্ধস্য তরণী ভার্ষা’ নাটকটির পরিণতিতে আদর্শ না থাকলেও শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন নাট্যকার। সংলাপে চাতুর্যতা ও সুসংবদ্ধতায় অঙ্কুরিত করেছে নাট্যকারের শিল্পপ্রতিভার বীজ। বিভিন্ন দিক বিচার বিশ্লেষণ করে সমালোচকগণ একে স্বার্থক নাটক না বললেও লেখকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। তৎকালীন সমাজের চিত্রটা তুলে ধরেছেন তিনি নিখুঁতভাবে। তবুও একটা কথা না বলে পারা গেল না। মাটির থালায় ভাত না বেড়ে নাট্যকার বেড়েছেন রূপার থালায়। কারণ নাটকটি রচিত রাজা মহারাজ্য নিয়ে।

‘জমিদারদর্পণ’ মীর মশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় নাটক। এটি নির্মাণে স্বার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন নাট্যকার। সমাজকে বিধৃত করেছেন নাট্যকার স্থপতির মত। এ নাটকটির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ নাটকের। এ নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় জমিদার শ্রেণীর উৎপীড়ন। মানব চরিত্রের বাস্তব রূপ পাওয়া যায় এ নাটকে। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ইন্সপেক্টর, উকিল, মোক্তার ব্যারিস্টার সবই তৎকালীন সমাজের প্রতিনিধি। জমিদার দর্পণে শিল্পী তার অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশে উৎকণ্ঠিত নন; তার বক্তব্য ছিল সামাজিক সমস্যা বিষয়ক। শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের হৃদয়হীনতাকেই তিনি তুলেছেন মর্মস্পর্শী করে। নীলকরদের সম্বন্ধে তুলে ধরা নীলদর্পণের যেমন উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ জমিদার সম্বন্ধে অনুরূপ বক্তব্য ছিল মীর মশাররফ হোসেনের। জমিদার দর্পণের পরিসরে তুলে ধরেছেন দুর্বল প্রজাদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের, নিপীড়নের কাহিনী। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার জমিদারদের লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘‘জীবের শত্রু জীব, মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য’ বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী।’’ ‘জমিদার দর্পণে’ এটাই লক্ষ্য করা যায়। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘‘নিরপেক্ষভাবে আপন মুখ দর্পণে দেখিয়ে যেমন ভালমন্দ বিচার করা যায়। পরের মুখ তত ভাল হয় না। জমিদার সুতরাং জমিদারের ছবি অংকিত করিতে বিশেষ আয়াস আবশ্যক করে না। আপন মুখ আপনি দেখিলেই হইতে পারে। সেই বিবেচনায় জমিদার দর্পণ সম্মুখে ধারণ করিতেছি। যদি ইচ্ছে হয় মুখ দেখিয়া চরিত্রগুলো জীবন্ত হাওয়াওয়ান চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করেছে লম্পট জমিদারের। ইংরেজ ডাক্তার, বিচারকের চরিত্র নির্লজ্জ দায়িত্বহীন সরকারি কর্মচারীদের প্রতিভু। জিতু মোল্লা ও হরিদাস বৈরাগী ধড়িবাজ বকধার্মিক। এ নাটকে প্রবাদ প্রবচন আছে। ভাষার শৈল্পিক গুণ লক্ষ্য করা যায়।

‘এর উপায় কি’ প্রকাশিত ১৮৭৫ সালে। সমসাময়িক কালের সমস্যা চিত্রিত এখানে। সেকালের মদখোর দুশ্চরিত্র স্বামীদের নিষ্ঠুরতার শিকার স্ত্রীকে নিয়ে লেখা এ নাটিকাটি। স্বামীকে ফিরিয়ে আনা সৎপথে আর তাদের নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া থেকে কি উপায় মুক্তি পাওয়া যায় এ নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় তাই। মাতাল স্বামীকে সৎপথে আনার জন্য নায়িকা (রাধাকান্তের স্ত্রী) রায়মনীকে সাজিয়েছে ছদ্মবেশী প্রেমিক। ডক্টর কাজী আবদুল মান্নান বলেন, ‘‘সেকালের মদখোর, বেশ্যাখোর (?) স্বামী, যারা নাকি বানর হতে বাড়া ছিল। তাদের সুপথে আনার একটি পদ্ধতি মশাররফ হোসেন বলেছেন। লম্পট স্বামীর নিষ্ঠুর অবহেলা এবং নির্মম লাঞ্ছনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কলিকালের স্ত্রী কি উপায় করতে পারে তারও একটা পন্থা এর মধ্যে চিত্রিত হয়েছে।’’ আসলে সমাজের দুশ্চরিত্র লম্পট বাবুদের সুপথে ফিরিয়ে আনার সুন্দর চিন্তা থেকেই নাট্যকার এ নাটক নির্মাণ করেছেন সমাজের উচ্ছৃক্মখল মানুষকে একটু শাস্তি দিয়ে আবার সংসারের বাগানে রোপিত করাই ছিল মীর মশাররফ হোসেনের উদ্দেশ্য। এর ভাষা শ্রুতিকটু যেমন মাগমাগী, ভাতার প্রভৃতি শব্দ সাহিত্যে অচল কিন্তু ঊনিশশতকে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে প্রহসন জাতীয় রচনায়। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার ও নিন্দার বোঝা মাথায় নিয়ে এসব রচনা করেছেন নাট্যকার। লম্পট চরিত্র সংশোধিত করে সংসারে শান্তি আনার প্রচেষ্টাই নিয়েছেন এখানে। নাটক যে সমাজের আয়না মীর মশাররফ হোসেনের নাটকগুলো পড়লে তা উপলব্ধি করা যায়। মীর মশাররফ হোসেনের নাটকগুলোতে সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে সমাজ গঠনের প্রভাব ছিল বেশি।

উপন্যাস : রত্নবতী (২রা সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ), বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ), গাজী মিয়ার বস্তানী (১৮৯৮-১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) রস রচনা, তহমিনা (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ), বাঁধা খাতা (১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ), নিয়তি কি অবনতি (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ)।

নাটক : বসন্ত কুমারী (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), বেহুলা গীতা ভিনয় (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) গীতি নাট্য। নাটক : বসন্ত কুমারী (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), বেহুলা গীতা ভিনয় (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) গীতি নাট্য। যাত্রা : টালা অভিয়ন (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)। প্রহসন : এর উপায় কি? (১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ), ভাই ভাই এইতো চাই (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ), ফাঁস কাগজ (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ), একি? (১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দ)।

প্রবন্ধ : গো-জীবন (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ), মুসলমানের বাংলা শিক্ষা (১৯০৩-১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)। জীবনী : আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত ইউসুফ (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ), বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ)। কাব্য : গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ), পঞ্চনারী (১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ), মৌলুদ শরীফ (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ) গদ্য, পদ্য।

ধর্মীয় গ্রন্থ : খোত্বা (১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ), প্রেম পরিজাত (১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত বেলালের জীবনী (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত ওমরের ধর্ম জীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত আমীর হামজার ধর্ম জীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), মদীনার গৌরব (১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ), মোসলেম বীরত্ব (১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ), বাজী মাৎ (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ), ইসলামের জয় (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) গদ্য ও পদ্য। পত্র-পত্রিকা : ‘হিতকরী’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ‘আজিজন নেহার’ নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

মীর মশাররফ হোসেনের পূর্বে, বাংলা সাহিত্যে কোনো উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যসেবী দেখা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে তিনি আধুনিক সাহিত্যের প্রথম সার্থক সাধক ও স্রষ্টা। তার সাহিত্যের ভাষা প্রাণোচ্ছল ও বেগবান। আধুনিক যুগের মুসলিম বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিভার অধিকারী, সমাজ হিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন তার নানা কাব্য ও সাহিত্যে বাংলার মুসলমানকে প্রাচীন মুসলিম গৌরব ও ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, জীবনীকার ও শ্রেষ্ঠ সমাজ সচেতন ব্যক্তি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, মুসলমান সমাজের পথ প্রদর্শক মীর মশাররফ হোসেন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রায় ৬৪ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।