বুধবার , ২০ নভেম্বর ২০১৯ | ৯ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
  1. article
  2. Artist
  3. কবিতা
  4. কলাম
  5. গল্প
  6. গুণীজন

নারী মুক্তি ও মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কবি সুফিয়া কামাল

প্রতিবেদক
রুদ্র আমিন
নভেম্বর ২০, ২০১৯ ৫:২২ অপরাহ্ণ
কবি সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত নবাব পরিবারে। তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তার মায়ের নাম নবাবজাদী সৈয়দা সাবেরা খাতুন এবং তার বাবা সৈয়দ আবদুল বারি ছিলেন উকিল। যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দি জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন।

মাত্র সাত বছর বয়সে সুফিয়া কামাল তার বাবাকে হারান। মাত্র বারো বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৩ সালে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিবাহ হয়। নেহাল হোসেন অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করেন। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে কলকাতা চলে আসেন। ১৯২৩ সালে সুফিয়া কামাল রচনা করেন তার প্রথম গল্প সৈনিক বধূ যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা বাসন্তী প্রকাশিত হয়।

১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল যোগ দেন বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলামে। এখানে নারী শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার আদর্শ সুফিয়াকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৩১ সালে সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান মহিলা ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে তাঁর স্বামী নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় ফেলে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি তার সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটির প্রশংসা করেন।

১৯৩৯ সালে কামালউদ্দীন আহমেদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় বেগম সুফিয়া কামাল ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান। ১৯৪৭-এ কলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত বাঙালী নারীদের প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বেগম’ -এর প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই দেশ বিভাগের পর তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বেগম সুফিয়া কামাল সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন। তিনি যেসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনা করেন তার মধ্যে আছে, বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি, দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বেগম সুফিয়া কামাল নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তার দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আগরতলায় হাসপাতাল স্থাপন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কারফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে বেগম সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), একাত্তরের ডায়েরী, মোর যাদুদের সমাধি পরে, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল (১৯৫১), কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি। ২০০২ সালে বাংলা একডেমী সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে। সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ লাভ করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলা একডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

সামাজিক ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এক বিশাল শক্তির প্রতীক। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। তার নিজের জীবন ছিল সরল সাদামাটা ঘরোয়া। বিশিষ্ট সামাজিক হয়েও পোশাক বা চলাফেরায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাধারন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ দিনগুলোতে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি নয়মাসে নয়টি কাঁথা সেলাই করেছেন। ধর্মের কল্যানকর রুপটিই তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবধর্ম তাঁর কাছে কখনো পরস্পর বিরোধী হয়ে দেখা দেয়নি। নিজ ধর্মের আচার অনুষ্ঠানগুলো পরম নিষ্ঠায় পালন করেও তিনি ছিলেন অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সকল রকম সা¤প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্দ্ধে, আলোকিত সমাজ গড়ার অভিযাত্রায় তাঁর এই জীবনাদর্শ আমাদের চলার পথের প্রেরণা।

প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে-সংগ্রামে সুফিয়া কামাল অগ্রণীভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু কখনো কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি। দেশ বা জাতির কাছে তার অবদানের বিনিময়ে তিনি কখনো মন্ত্রী সাংসদ বা রাষ্ট্রদূত হতে চাননি। দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার, সম্মান ও স্বীকৃতী তিনি পেয়েছেন, কিন্তু তার জন্য তিনি কখনো কোনো তদবির-উমেদারী করননি। নিজ চরিত্র মাধুর্য্য ও সেবাপরায়নতায় সকলের মন জয় করে শ্রদ্ধা সম্মানের পাত্রী ছিলেন তিনি।
মহীয়সী এই নারী ৮৯ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যাকে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।