ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের অনভূতি কত বিচিত্র। কত তুচ্ছ কারণে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, আবার ওলট-পালট করা ঝড়েও কী শান্ত , কী স্থির মানুষের হৃদয়। ভালোবাসার গল্প গুলোতেও তাই ছড়িয়ে থাকে রহস্যময়তা, বৈচিত্রতা। সে সব গল্প ঢেউ তোলে প্রেমিক হৃদয়ে, মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের কথা। এমন ঘটনাও আছে যা অন্যের স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
তন্ময়, তানিম, মির্জা, একে অপরের খুব কাছের মানুষ, প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় তাঁরাই সবাই সবার প্রিয়, আপদে বিপদে সব সময়ই একজন অন্যের পাশে হিমালয় পর্বতের মতোই দাঁড়িয়ে যায়।
তন্ময়কে দেখে আজ একটু অন্য মনষ্ক মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক সে এমন থাকে না, জীবন ঝড়ের মাঝেও সে হাসি-খুশী একজন মানুষ, এমনটা দেখে তানিম জিজ্ঞেস করলো, কিরে তোর কি হয়েছে? এতো মন মরা কেন লাগছে তোকে? না তেমন কিছুই নয়, তাহলে কেন এমন দেখাচ্ছে আমাদের দৃষ্টিতে, তোর সমস্যার কথা তো আমরা জানতেই পারি তাই নয় কি? সমস্যার কথা না বললে যে সমস্যা সমস্যাই থেকে যায় বন্ধু। নারে, তেমন কোনো সমস্যা হয়নি বন্ধু, তবে এমন লাগছে কেন তোকে? একটা বিষয় নিয়ে খুব ভাবতে ছিলাম, ভাবনাটা অবশ্যই আনন্দের, তোদের নিকট মন-মরা মরা লাগছে সেটাও ঠিক, যদি তোরা গল্পটা শুনতে চাস তবেই বলতে পারি, তোদেরও শুনতে ভালো লাগবে কেননা ঘটনা সত্য, এমন ঘটনা সিনেমায় সাজানো দেখেছি কিন্তু বাস্তবতায় এর আগে এমন গল্প দেখিনি কিংবা শুনিনি। তুই বল দেখি, শুনি তোর বাস্তব ঘটনা।
আজ থেকে তিন বছর আগের কথা, তখন আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের ঢাকায় বসবাস ছিলো, যে বাড়িতে ভাড়া থেকেছি তার পাশের বাড়িটাই মৌমিতা আপুদের ছিল। কি যে সুন্দর দেখতে ছিল সে সেটা না দেখলে তোরা বুঝবি না, টানাটানা চোখ দুটো সবসময় ঝলমল করতো, মেঘ কালো দীঘল চুল, গালে টোল ফেলে যখন হাসতো, তখন মনে হত পৃথিবীও যেন হাসছে, মিষ্টি দাঁত গুলো এতো পরিপাটি করে সাজানো আর চকচকে যেন পূর্ণিমা রাত।
তাদের বাগানের আম গাছের আম চুরি করতে গিয়ে কতবার যে ধরা পড়েছি, তার শেষ নেই, আর যখনি ধরা পড়েছি মৌমিতা আপুর দাদীর হাতে, কখনো কখনো লাঠি হাতে তেড়ে এসেছেন তখনি স্বর্গের দেবী হয়ে তাকে বাঁধা দিয়েছেন। আপু দাদীকে বলতেন, “আহা দাদী, থাক না, তানিম তো লক্ষ্মী ছেলে, তাই নারে তানিম? আয় এদিকে আয়” ডেকে কাছে নিয়ে যেতেন আপু, আমি লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে এগিয়ে যেতাম। মৌমিতা আপু আমার গাল টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে হাতে ক’টা আম ধড়িয়ে দিতেন। তখন সম্ভবত আপু কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। একবার আপু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে মরতে মরতে বেঁচে যান, তাঁর এ বেঁচে যাওয়ার পিছনে আছে প্রথমত আল্লাহ এবং তার পরে এক অচেনা যুবক।
তন্ময় তানিমকে বলে, মূল কথা বল দোস্ত। শোন, ঐ সময় থেকেই আপু ডায়েরী লিখে রাখতেন প্রতিদিনের কথা প্রতিদিন, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে উঠার পর থেকেই আপু অচেনা সেই আগুন্তককে খুঁজে ফিরতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লাস মিস করতেন তিনি নির্দিষ্ট সময়ে, শুনলাম তাদের ঘটনা নিয়ে কেউ একজন ভালোবাসার গল্প লিখেছেন, সেই গল্পের নাম দিয়েছেন “মৌমিতার ভালোবাস”।
মৌমিতার সাথে আমার প্রথম দেখা আজ থেকে প্রায় দু’বছর আগে, কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন প্রায় ডুবতে যাচ্ছে ঠিক এমন সময়ে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আসছিলাম। এমনিতেই সারাদিনের কাজের চাপে প্রচন্ড ক্লান্ত। বাসে একটি সিট পেতেই বসে পরলাম। কড়া সুগন্ধি ঘ্রাণ আমাকে বরাবরই শত্রু বানিয়ে দেয়। বাসের ডান পাশ থেকেই বাতাসে ভেসে আসছে ঘ্রাণ। বাসের শেষ সিটের ডানপাশের শেষ যাত্রী যেহেতু আমি সেহেতু পিছন দিক থেকে ঘ্রাণ আসার কোনো প্রশ্নই নেই। দীঘল কালো চুলের অধিকারী প্রথম থেকেই বেশ যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল, তবে এটা সত্যি এতো ভালো চুল আমার মতো প্রায় পুরুষের প্রিয় হবে, কোমড়ের নিচু প্রায় হাটু ছুই ছুই নেমে আসা কোকড়ানো চুলগুলো, মনে হচ্ছে বাতাস সেও উতলা হয়েছে চুলে এবং সুবাস। কয়েকবার জানালাটা টেনে দিতে বলা হয়েছিল, টেনেও দিয়েছিলো কিন্তু যতবার টেনে দেয়া হয়েছে ততবারই জানালা খুলে গেছে, আসলে ঢাকা শহরে গাড়ী চলে ব্রেকের উপর ভর করে, কিছুদূর যেতে না যেতেই কড়া ব্রেক এভাবেই গন্তব্যে ছুটে চলা।
–চলবে