হরি বিষয়টা খুব কৌশলে এড়িয়ে গেলো কেন, বুঝতে পারলাম না, এখন আমাদের গাড়িটা যেন একটা বাঁশ বাগনে প্রবেশ করেছে, হরি আমাকে বললো , বাবু তুই কিন্তু ভয় পাসনে, আমি বললাম, এখন আবার কি আপদ, হরি বললো, বাবু তুই শহর থিকা আইছিস, হামাদের সবচেয়ে খারাপ রাস্তা হলো এটা, এখানে রাত হলেই পেতœীদের উৎপাত, কেউ ডাক দিলে উত্তর নিবি না, আমি এর কোন উত্তর দিলাম না, এ সময় আমার ফজলে এলাহীর উপর খুব রাগ হচ্ছে, গাদাটা এত খারাপ একটা জায়গার ব্যাপারে কেন আমাকে জানায়নি, এ বয়সে থ্রীল কি ভালো লাগে, শরীরের সব কিছু এখন বয়স্ক হয়ে গেছে, বিপদে পড়লে তো দৌড়ে জান বাঁচানো যাবে বলে মনে হয় না। হঠাৎ চারপাশে বাঁশবাগানে যেন খুব হইচই শুরু হয়ে গেলো, কারা যেন বাগানটাকে রণক্ষেত্রে পরিনত করছে, এখন গাড়ির গতি কেমন যেন কিছুটা কমে কমে যাচ্ছে, গাড়ির মহিষ গুলো কোম ঘোৎ ঘোৎ করে উঠছে, হরি বললো, বাবু উত্তর নিও না কিন্তু, কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মেয়ের কান্না শুনতে পেলাম, এ আবার কি আপদ, এই বাঁশবাগানের ভিতর আবার এ রাতে কি হলো, গাড়ি চলছে ধীর গতিতে, হঠাৎ কান্না থামিয়ে নারী সুরে মেয়েটা বলে উঠলো কে গো, কে যাও, আমাকে একটু লিয়ে যাও না গো, কে কে গো লিয়ে যাওনা আমাকে, এর পর থেমে থেমে কান্না , কে গো বাবু, আমাকে লিয়ে যা, লিয়ে যা বলছি, হঠাৎ একটা ঝাকুনির হলো, মেঘ বৃষ্টি নেই অথচ কোথায় যেন একটা প্রচন্ড শব্দ নিয়ে বাজ পড়লো, মনে মনে সৃষ্টির্কতার নাম জপ করছিলাম, গাড়ির গতি বেড়ে গেলো, মনে মনে ভাবছিলাম, আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি ভোর দেয়, সকাল হলেই এখান থেকে ছুটে ঢাকা চলে যাবো, আমার সব আগ্রহ এখন মাথার ভিতর থেকে উড়ে যাচ্ছে ।
কতক্ষণ ধরে অজ্ঞান ছিলাম জানি না, চোখ মেলে দেখি, একটা বিছানায় শোয়া, নমষ্কার বাবু, আজ্ঞে আমি পরাণ মাষ্টার, আপনাকে বাড়ির গেইটের সামনে পড়ে থাকতে আমার অন্ধ কুকুরটা খবর দিলো, তারপর আপনাকে নিয়ে এলুম, মাথায় আরেকটা বারি খেলো, আমি তো হরির গাড়িতে ছিলাম আর অন্ধ কুকুর আমাকে খুজে পায় কীভাবে? পরাণ বাবু আবার বললেন, মহাশয় পরিচয়টা যদি দিতেন, আমি বললাম এটা কি টগরপুর? পরাণ বাবু বললেন আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বললাম আচ্ছা তুমি কি ডাঃ ফজলে এলাহী কে চেনো? সে আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে, পরাণ বাবু মাথা নেড়ে বললো, আজ্ঞে কর্তা জ্বী, আপনাকে রেল ষ্টেশনে আমার থাকার কথা ছিলো, ঘরে আজ নতুন অতিথি এসেছে, তাই যেতে পারিনি, নগেন্দ্র কে পাঠিয়েছিলাম, সে মনে হয় পথে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করবেন, তা আপনি এখানে এলেন কি করে? আপনাকে কে পথ দেখিয়েছে? আমি বললাম গাড়োয়ান হরি? পরাণ বাবু হরির নাম শুনে অস্পষ্ট ভাবে বললেন রাম রাম রাম কি বলছেন বাবু, পরাণ গাড়োয়ান তো আজ থেকে বাইশ বছর আগে পরপারে চলে গেছে, এ এলাকার অনেকেই হরির খপ্পরে পড়েছে, তাদের কেউ বেশি দিন বাঁচেনি, সবাই কোনো না কোনো অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, বাবু অনেক পরিশ্রম করে এসেছেন, আপনি বিশ্রাম নিন, সকালে কথা হবে, ঘরে জলখাবার রাখা আছে, ক্ষুধা পেলে খেয়ে নিতে পারেন। আমি বললাম হরি কি তবে মরে গিয়ে ভূত হয়ে গিয়েছে, আর সেটা কি তোমরা বিশ্বাস করো, পরাণ বাবু বললেন, বাবু সে অনেক লম্বা কথা, সকালে না হয় শুনে নিবেন ।
পরাণ বাবু চলে যাওয়ার পর থেকে, নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না, এসব কি হচ্ছে আমার সাথে, অন্ধ কুকুর, মৃত হরির সাথে সাক্ষাৎ কিংবা পরাণ বাবু এবং অবশেষে টগরপুর। ব্যাগ হাতড়ে রোগীর জন্য রাখা মানসিক রোগীদের কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম, ঘুম আসছে না, বিছানার এপাশ ওপাশ করছি, কিছুটা যখন তন্দ্র এলো, তখন চোখের সামনে চলে এলো গাড়োয়ান হরি আর তার সেই মহিষের গাড়ি, হরি বললো বাবু আমি বড় কষ্টে আছি, বাবু আমি বড় কষ্টে আছি, ইংরেজ সাহেব আমারে ছুটি দিলো না, আমার বউয়ের সাথে আর দেখা হলো না তার মৃত্যুর আগে, তুই জানিস বাবু, ইংরেজ বাবুকে ছোড়া দিয়ে গলা কেটেছি প্রথমে তারপর ওর কলিজাটা হাতে নিয়ে গাড়ি করে রওয়না দিয়েছিলাম, পথে ইংরেজ সাহেবের বন্দুক ওয়লা প্রহরী গুলো হামার মহিষ গুলোকে গুলি করে মেরেছে, ওরা হামার সন্তানের মত ছিলো রে বাবু, ওরা হামার সামনে ছটফটিয়ে মরে গেলো, তাঁদের রক্ত হামার সারা শরীরে মেখেছে, এরপর ওরা হামাকে গুলি করেছে বাবু, হামাকে গুলি করেছে , তাও ওরা আমাকে চিতায় দেয় নাই বাবু, মৃত্যুর পর এটা কি করতে পারে নাই, ওরা কত নিষ্ঠুর বাবু তুই জানিস না, হামার শবদেহটা জঙ্গলে চার দিন পড়ে ছিলো, এর পর শেয়াল পশুতে খেয়েছে, বাবু তুই ভালো মানুষ, তোর ক্ষতি হামি করতে চাই নাই, তুই চলে যা এখান থেকে, তুই চলে যা, এখানে কেউ জীবিত নাই, সবই মরা বাবু, সবই মরা, পরান মাষ্টারও মরা । তুই চলে যা বাবু, ভগবানের দোহাই তুই চলে যা।
সকাল বেলা পরাণ বাবুর কণ্ঠ শুনে ঘুম ভাঙ্গলো, সে বললো, নমস্কার বাবু, রাতে ঘুম কেমন হলো, আমার ঘুম তেমন ভালো হয়নি, রাতে স্বপ্নে হরির আগমন ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম, কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম, পরাণ বাবুকে বললাম, মাষ্টার বাবু আমি যে কাজে এসেছি তাঁর বন্দোবস্ত করেন আমি আজ দু-একজন রোগী দেখতে চাই, এরপর পারলে আজই আমাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, পরাণ মাষ্টার বাবু বললেন, কি যে বলেন ডাঃ বাবু কাল সকালের আগে কোন ট্রেন নেই, আপনাকে আজকের রাতটা তো এখানে থাকতেই হবে, রোগীদের খবর দিয়েছি, ওরা আসতেছে, আমি বরং আপনার জলখাবারের ব্যবস্থা করছি, আপনি যদি কুয়ো তলায় গিয়ে একটু স্নান সেরে নিতেন, ওখানে রেনুবালা আপনার জন্য জল তুলে রেখেছে, আমি বললাম ঠিক আছে তুমি যাও, আমি আসছি। ঘুম চোখে থাকলেও এ সময়ে আমাকে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না, ভাবলাম আমার মনে হয় কোন ঘোর লাগা মানসিক সমস্যার ভিতরে আছি, ডাঃ যখন রোগী সেখানে ওষুধ দিবে কে? ঘরের দুয়ার খুলতেই দরজাটা যেন ক্যাচ ক্যাচ করে কেঁদে উঠলো, অনেক পুরাতন আমলের বাড়ি মনে হয়, কিন্তু একি বাহিরে রোদের ছিটেফোটাও নেই, চারদিকে ঘন কুয়াশা, কিন্তু এই ভর বর্ষা কালে তো কুয়াশা হওয়ার কথাই না, দুরে একটা কুকুরকে ঘেউ ঘেউ করতে শোনা যাচ্চে, কুয়োতলাটা নিশ্চয়ই ঐ দিকে হবে, হেটে হেটে যাচ্চিলাম, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আশে পাশে কোন বাড়িও দেখতে পারচ্ছি না, কোন লোকজনও নেই । একটা গ্রামে এত বড় কাঠের বাড়ি অথচ আশে পাশে কোন মানুষের চিহ্ন নেই, ব্যাপারটা অদ্ভত লাগছে ।
— চলবে