কুয়োটা দেখে বুকের ভিতরটা আরো মোচড় দিলো, এত বড় কুয়ো আমি এর আগে দেখিনি, কুয়োর ভিতরটা দেখে বুকটা শুকিয়ে গেলো, এর কোন তলানি দেখতে পেলাম না, হয়তো কুয়াশার কারণে এটা হতে পারে, কুয়ো পাড়ে দেখি জল তোলা আছে, বিশাল বিশাল পিতলের কলস পাতিলে জল, তাতে এককেটায় এক এক সুগন্ধ মাখা, এই গ্রামে এই সুগন্ধযুক্ত পানি, ইতিহাস থেকে জেনেছি অনেক আগে রাজা-বাদশাহরা নাকি স্নানের জলে কর্পূর সুগন্ধি আতর মেশাতেন। কিন্তু এই গ্রামে পারণ মাষ্টারের মত লোকের বাড়িতে এই ব্যবস্থা, ব্যাপক আশ্চার্য লাগছে, জল গুলো কিছুটা গরম মনে হচ্ছে, হয়তো ফুটিয়ে আনা হচ্ছে, হঠাৎ একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম, নমষ্কার বাবু, আমি রেণুবালা, বাবু আমি একজন দাসী, আপনার সেবায় মাষ্টার বাবু আমাকে পাঠিয়েছেন, আমি কি আপনাকে জল ঢেলে দিবো, আপনি চাইলে আপনার শরীর ঘষে মেঝে দিতে পারি, আমি চোখ তুলে রেণুবালার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম, এ যেন নারী নয় সাক্ষাৎ দেবী, বয়স পনেরর বেশি হবার কথা নয়, কিন্তু এ বয়সে নারী র্স্পশ, সেটা কেমন বেমানান লাগবে, আর এই বিপদসংকুল এলাকায় এমন রসিকতা মানায় না, আমি বললাম, না রেণুবালা আমার কিছুই লাগবে না, এত এত পদের পানি এনেছো কেন? আমি সাধারণ জলেই স্নান করে নিতে অভ্যস্ত।
রেণুবালা বললো, জ্বী কর্তা বাবুর আদেশ ছিলো, আপনি এত দুর থেকে এসেছেন, আপনি আমাদের অতিথি, মাথায় জল ঢালতে ঢালতে রেনুবালাকে জিজ্ঞাস করলাম তোমার সংসার হয়নি? বাচ্চা কাচ্চা কয়জন, তোমার স্বামী কি করে? রেণুবালা বললো, বাবু সে কথা আর বলতে নেই, আমার পতি দেবের নাম হলো হরি, সে গাড়োয়ান ছিলো, গত হয়েছে, ছেলে মেয়ে নেই, এখন আর সংসারের ইচ্ছে নেই, এরপর থেকে পরাণ বাবুর ঘরেই আছি, পরাণ বাবু ভালো মানুষ, সুখেই আছি এখানে। জল ঢালতে ঢালতে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছি, এত আরাম আমি কখনও পাইনি, এ যেন স্বর্গীয় জল। মাথা থেকে জল নেমে যাওয়ার পর, কুয়োটার একটা ফলকের দিকে চোখ পড়লো, সেখানে লেখা রয়েছে শ্রী শ্রী হারাণ সাহা, স্থাপতি-১৭৮২ইং, ভিতরটা চমকে দিলো, যেন আমি এত পুরাতন একটা কুয়োর পাশে বসে আছি, শরীরের লোম সব খাড়া হয়ে গেলো, হঠাৎ মনে পড়লো আমি যেন কার সাথে কথা বলছিলাম, ওহ রেনুবালা, ওকেই জিজ্ঞাসা করি ।
শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল, যখন মনে পড়লো, আমি এতক্ষণ কার সাথে কথা বললাম, কুয়ো তলায় তো কেউ নেই, আর রেণুবালা সেই দেবী? সে কোথায়? সে তো বলেছিলো তার পতির নাম হরি গাড়োয়ান, গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো, গত রাতে বাঁশ বাগানে যে মেয়েটা ঘোঙ্গানীর মত বলেছিলো তাকে নিয়ে যেতো, সে নয়তো, নাহ আর কিছুই ভাবতে পারছি না, শরীর মুছে ঘরের দিকে রওয়না দিলাম, সেই একই অবস্থা কোথাও কেউ নেই, চারদিকে শুনশান নিরবতা। ঘরে ঢুকে ডায়েরীটা খুলে নিলাম, গতকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নোট করে রাখা দরকার, পরে হয়তো কাজে আসবে। ঘরের দরজাটা যেন আবার কেঁদে উঠলো ক্যাঁ করে শব্দ হলো, পরাণ মাষ্টার এসেছেন, সে বললো ডাঃ বাবু স্নান কি শেষ হয়েছে? আমি বললাম হ্যাঁ শেষ, তুমি এসো, পরাণ বাবু আবার শুরু করলেন, বাবু গতরাতে আপনি বড় বাঁচা বেচেঁ গেছেন, ইংরেজ বাবুকে মারার জন্য তারও মৃত্যু হয়েছিলো, সারা গ্রামে ঢেড়া পিটিয়ে বলা হয়েছিলো তার লাশ যেন কেউ সৎকার না করে, পাশের জঙ্গলে পড়েছিলো, শিয়াল কুকুরে খেয়ে নিয়েছে, সেই থেকেই আপদ, প্রায়শই রাতের বেলা নাকি সে তার গাড়ি নিয়ে বনের পথে ঘুরে বেড়ায়, ভিন দেশি লোক দেখলে তুলে নেয়, এরপর ওদের মড়া পাওয়া যায় খালের ধারে, বাঁশ বাগানে, এখান ওখানে। মনে মনে আরও শক্ত একটা প্রমাণ চলে এলো, তবে গত রাতে স্বপ্নযোগে হরি যা বলেছে তা মিথ্যা নয়, আর ঐ যে রেণুবালা, তাহলে সেটাও ওদের দলেরই, পরাণ বাবু বললেন ডাঃ বাবু যদি কষ্ট না হয়, কয়েকজন রোগী এসেছেন, আপনি যদি ওদের দেখতেন। আমি বললাম আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন, তবে আগামী দশ মিনিট পর, আমি একটু নিজেকে গুছিয়ে নিই, পরাণ মাষ্টার মাথা নেড়ে বললেন, জ্বী আজ্ঞে, তাহলে আমি একটু আসি।
টগরপুরে এই প্রথম হয়তো কোন রোগী দেখবো, এখানে এসে যে রকম ভৈতিক পরিবেশে পৌছে গেছি, তাতে রোগীদের কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে, এরা নিশ্চয়ই বেশি একটা ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়, পরাণ মাষ্টার রোগী নিয়ে আসার কথা বলে চলে গেছেন, দশ মিনিট এরপর আরও বিশ মিনিট শেষ হতে চললো, তাদের দেখা নেই, কাঠের এই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় আছি, আমার রুমটা কিঞ্চিত অদ্ভূত চারদিকে এতো খোলামেলা থাকতেও, একটা মাত্র জানালা, এই রুমে প্রবেশের পর থেকে তা আর খোলা হয়নি, রুমটা অনেকদিন ধরে যে ব্যবহার হচ্ছে না, তার কিছু নমুনা আশে পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, একটা মাত্র রুমের একটা মাত্র জানালাটা খোলার ইচ্ছে হলো, একটু আলো বাতাস এলে মন্দ হয় না, চেয়ার থেকে উঠে জানালাটা খুলেই অবাক হয়ে গেলাম, জানালার ওপাশে সারি সারি কবর, দেখে মনে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৌনিকদের কবর, কিন্তু এই গই গ্রামে এত সৈনিকদের কবর হতে যাবে কেন, আর থাকলে এটা এত দিন জানার কথা। বাহিরে এখনও কুয়াশা। কোন লেখক টাইপের কেউ এ গ্রামে থাকলে হয়তো এ গ্রামের নাম পাল্টে টগরপুরের বদলে রাখতেন কুয়াশাপুর গ্রাম। জানালা খুলে আর রোদ পাওয়া গেলো না, শুধু সান্ত¡না একটু বাতাস যদি আসে।
— চলবে