‘নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কালচারের আদেশ।’
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা যার কাছে অভিন্ন ছিল, সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ সেই পথিকই মোতাহের হোসেন চৌধুরী। মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রবক্তা, মানবতাবাদী ও মননশীল প্রবন্ধকার তিনি। বিশুদ্ধ মননের সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষক মোতাহের হোসেন চৌধুরী একদিন কলেজের অনুষ্ঠান শেষে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন। রাতে বসেছিল গানের আসর। নিজে অসুস্থ বোধ করায় শ্যালিকা জাহানারাকে (রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহানারা ইসলাম) অনুরোধ করলেন তাঁর প্রিয় কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে। আসরের শেষ গানটি ছিল ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে’। এ গান শুনতে শুনতেই সীমার প্রাঙ্গণ ছেড়ে অসীমের অঙ্গনে চিরতরে চলে গেলেন তিনি।
বাঙালির চিৎপ্রকর্ষের উন্নতির জন্য আজ বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে পড়া জরুরি। একটি সভ্যজাতি কিভাবে বুদ্ধি, চিন্তা, প্রগতি, ব্যক্তিত্ব, মানবতা ও সৌন্দর্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে তা জানার জন্য মোতাহের হোসেন অবশ্যপাঠ্য।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯০৩ সালে নোয়াখালীর কাঞ্চনপুর গ্রামে। তার সঠিক কোন জন্মদিন, তারিখের অনুসন্ধান করেও আমি পাইনি বলে এখানে উল্লেখ করতে পারলাম না। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)- এর পৌত্র মোতাহার হোসেন চৌধুরীর পিতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল মজিদ ও মা ফাতেমা খাতুন। মাতামহ ছিলেন কুমিল্লার বিখ্যাত দারোগা বাড়ির মৌলভি আশরাফ উদ্দীন। পিতা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। কর্মসূত্রে তিনি বাইরে থাকতেন। স্ত্রী ফাতেমা খাতুন সন্তানসহ থাকতেন পিতার কাছে। কিন্তু অল্প বয়সে মোতাহার হোসেন চৌধুরী পিতৃহারা হন। তাই নানাবাড়িতেই বেড়ে ওঠেন তিনি।
কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইউসুফ হাইস্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয়। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৪৩ সালে। এরপর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে যোগদান করেন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করেন ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদেই অধিষ্ঠিত থাকেন।
এ কলেজে তার সহকর্মী ছিল প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল। এছাড়াও জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখ’র সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
আমাদের বাংলার অন্যতম মানবিক চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলনও চোখে পড়ে। মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘সংস্কৃতি সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী’ প্রকাশিত গ্রন্থটিও বেশ প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই অকুতোভয় লেখকের সামগ্রিক রচনাকর্মের ওপর যে তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতাযুক্ত আলোচনা আমরা আলোচ্য সংকলনে লক্ষ করি । দীর্ঘ কলেবরে, অনেক লেখার সমন্বয়ে সংকলিত এই সংকলন বাঙালী পাঠককে অন্তত নতুন করে মোতাহের হোসেনকে চিনিয়ে দেবে। নতুন সময়ে নতুনভাবে পাঠক হয়তো আবিষ্কার করবেন এই মননশীল লেখক চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিসেবককে। এই সংকলন আমাদেরকে সজাগ করে তুলবে আমাদের সাংস্কৃতিক চারিত্র্যকে বুঝে নিতে।
মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রবক্তা, উদার মানবতাবাদী ও মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবে মোতাহের হোসেন চৌধুরী অর্জন করেন বিশেষ খ্যাতি। ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। সাহিত্য সমাজের সভা ও সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত। লেখক রচিত ‘আমাদের দৈন্য’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’ ও ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা’ প্রবন্ধ তিনটি যথাক্রমে সাহিত্য সমাজের পঞ্চম (১৯৩১), ষষ্ঠ (১৯৩২) ও অষ্টম (১৯৩৪) বার্ষিক সম্মেলনে পাঠ করা হয়। এছাড়াও তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্যবিলাস’ প্রবন্ধটি সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’র পঞ্চম বর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
মোতাহের হোসেনের প্রবন্ধের গদ্যশৈলীতে প্রমথ চৌধুরী এবং মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’র প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তার রচনায় সংস্কৃতি, ধর্ম, মানবতাবোধ ও মানুষের জীবনাচরণের মৌলিক বিষয়গুলি সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচিত হওয়ার প্রয়াস দেখিয়েছে। বিচিত্র ও সুন্দর জীবনের মধ্যেও তিনি মহত্তোম জীবন খুঁজে বেড়িয়েছেন।
সাতচল্লিশোত্তর দেশভাগের ক্রান্তিকালে আমাদের সাহিত্যের আদর্শ, আঙ্গিক ও কলাগত ভাবনায় যখন আমাদের সংস্কৃতিক্ষেত্র চঞ্চল, বিবিধ বৈরী মতবাদ ও মতভেদের প্রচন্ড ঝড়ে আন্দোলিত, তখনো এই নেহাৎ অধ্যাপক মানুষটি নীরবে আপন সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন ছিলেন, মতবাদ ও মতভেদের বিভিন্ন ঝঞ্ঝাঘাত থেকে বহু দূরে। এবং সেজন্যই সম্ভবত কোনো দলীয় নামাবলী, ‘মতবাদ’ বা ‘ইজম’ তার লেখাকে আক্রন্ত করেনি, বরং সকল প্রকার মতাদর্শকে অশ্রদ্ধা না করেও তার নিজস্ব ভুবনে, স্বকীয় শিল্পলোকে পরমহংসের মত সন্তরণ করেছেন, আপন সৌরলোকে ঘুরেছেন, তার বিশ্বাস ও চেতনালোক থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তার দৃঢ় প্রত্যয়ে ও প্রগাঢ় প্রজ্ঞায় তার বক্তব্যের বুনন দৃঢ় এবং সুদৃঢ় ছিল।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতাদর্শের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত করতে পারেন, কিন্তু তার লেখার মধ্যে যে সাধুতা, সৎ উদ্দেশ্য, সূক্ষ্মতা ও সাধনা ফুটে ওঠে তা কেউ অস্বীকার করবে না। ইউরোপীয় উদারনৈতিক ভাবধারা দ্বারা মোতাহের হোসেন চৌধুরী গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ব্যক্তি ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ চিন্তার ব্যাপারে ক্লাইভ বেল ও ব্রাটার্ন্ড রাসেল দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর এই প্রভাবেই তিনি তাঁর রচনায় সংস্কৃতি, ধর্ম, মানবতাবোধ ও মানুষের জীবনাচরণের মৌলিক বিষয়গুলি সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচিত করতে চেয়েছেন এবং বিচিত্র ও সুন্দরভাবে বাঁচার মধ্যে মহত্তম জীবনের সন্ধান করেছেন। সংস্কৃতি কথা (১৯৫৮) তাঁর প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থ। দ্বিতীয় গ্রন্থ সুখ (১৯৬৫) বার্ট্রান্ড রাসেলের Conquest of Happiness গ্রন্থের এবং তৃতীয় গ্রন্থ সভ্যতা (১৯৬৫) ক্লাইভ বেল-এর Civiliszation গ্রন্থের ভাবানুবাদ।
‘সংস্কৃতি কথা’ (১৯৫৮) তার প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থ। বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘কনকোয়েস্ট অফ হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের অনুবাদ ‘সুখ’ (১৯৬৫) তার দ্বিতীয় গ্রন্থ এবং তৃতীয় গ্রন্থ ক্লাইভ বেল-এর ‘সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থের ভাবানুবাদ ‘সভ্যতা’ (১৯৬৫)।