“সাহিত্য করে বা কবিতা দিয়ে আমি বিত্ত-বৈভব কামাতে চাইনি, আমার আকাঙ্ক্ষা ছিলো এই কবিতা দিয়ে আমি যাতে মানুষ কামাতে পারি।” – হেলাল হাফিজ।
কবি হেলাল হাফিজ এর ৭১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার ছিলেন নামকরা শিক্ষক। মায়ের নাম কোকিলা বেগম। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিলো হেলাল হাফিজের।
খেলেছেন ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ভলিবল। এমনকি নেত্রকোনার মতো জায়গায় তিনি লন টেনিসও শিখেছিলেন। কিন্তু বয়স যত বাড়তে থাকলো, মাতৃবিয়োগের বেদনা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে থাকলো। এই বেদনা থেকে মুক্তি পেতেই তিনি ঝুঁকে পড়লেন কবিতায়। একটু মমতা, একটু ভালোবাসার জন্য ছুটেছেন এদিক-সেদিক। পেয়েছেন লাঞ্ছনা, অনাদর; পেয়েছেন ভালোবাসাও। আর সেসব অনুভূতি থেকেই রচিত হয়েছে কালজয়ী সব কবিতা।
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”
এ দুটি লাইন শোনেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা হয়েছে কবিতার এ দুটি লাইন। কবিতার নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কবির নাম হেলাল হাফিজ। একটি মাত্র কবিতার বই দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হয়েছেন অমর। নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির কবিতাগুলো যেন একেকটি প্রেম আর দ্রোহের খনি। ভাষার এমন সুন্দর ব্যবহার, শব্দের এমন চমৎকার চয়ন, বিমোহিত করে তাবৎ কাব্যপ্রেমীকে।
হেলাল হাফিজ নির্ঝঞ্ঝাট একজন মানুষ। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু ডাক্তার হলে পড়াশোনার চাপে আর কবিতা লিখতে পারবেন না বলে ডাক্তারিতে ভর্তি হননি। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। থাকতেন তৎকালীন ইকবাল হলে, যা বর্তমানে ‘শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ নামকরণ করা হয়েছে। ইকবাল হল ছিল সেসময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ঘাঁটিগুলোর একটি। তৎকালীন দাপুটে সব ছাত্রনেতারা থাকতেন ইকবাল হলে।
হেলাল হাফিজ ইকবাল হলে থাকাকালীনই এসেছিল ২৫ মার্চের সেই গণহত্যার রাত। সেদিন তিনি নিউমার্কেটে আড্ডা দিয়ে হলে ফিরে গোসল করে চিন্তা করলেন, তার নেত্রকোনার এক বন্ধুর সাথে দেখা করবেন। সেই বন্ধু থাকতেন ফজলুল হক হলে। হেলাল ফজলুল হক হলে গল্পগুজব করতে থাকলেন। রাত এগারটার দিকে গোলাগুলি শোনা গেলো। হেলাল ফজলুল হক হলেই রয়ে গেলেন। কারফিউ শেষে ২৭ তারিখ তিনি ইকবাল হলে ঢুকতেই দেখলেন ৩০-৩৫টি লাশের একটি স্তূপ। ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুম। কোনোমতে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বের হতেই হলের গেটে নির্মলেন্দু গুণের সাথে দেখা হলো তার! নির্মলেন্দু গুণ এসেছিলেন হেলাল হাফিজ ঠিক আছেন কিনা তা দেখার জন্য। দুঃসময়ের এ মুহূর্তে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। তারপর তারা কেরানীগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। একটি কথা বলতেই হয়, ঘটনাগুলো যদি এভাবে না ঘটতো, যদি হেলাল ইকবাল হলে থাকতেন সে রাতে, তাহলে হয়ত আজকে আমরা এই কবিকে আর পেতাম না।
হেলাল হাফিজের সারা জীবনের অমর সৃষ্টি হলো ‘যে জলে আগুন জ্বলে‘। সতেরো বছর কবিতার লেখার পর ১৯৮৬ সালে এই বইটি তিনি প্রকাশ করেন।
দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর ২০১২ সালে আবার বই নিয়ে হাজির হন হেলাল হাফিজ। বইয়ের নাম ‘কবিতা একাত্তর’। ২০১৩ সালে হেলাল হাফিজকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে তার মতো প্রতিভাকে মূল্যয়ন করতে বাংলা একাডেমি হয়ত বেশ দেরিই করে ফেলেছে।
একদিন জনপ্রিয় টিভি তারকা শমী কায়সার হেলাল হাফিজকে প্রশ্ন করেছিলেন- প্রেম, ভালোবাসা বিরহ এগুলোকে কীভাবে দেখেন বা কীভাবে এ অনুভূতিগুলোকে ব্যক্ত করেন?
সেই প্রশ্নের উত্তরে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন: একেবারে চুম্বক দুটি বাক্য দিয়ে আমি আমার প্রেমের কথা বুঝিয়ে দেব। আমার কাছে অক্সিজেন, শস্যদানা, তারপরই প্রেম, তারপর কবিতা। প্রেম মানেই কিন্তু নারী-পুরুষের প্রেম নয়। তাজমহল নিয়ে তোমাকে [শমী কায়সার] চমৎকার একটি কথা বুঝিয়ে দেব। পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে আছে যারা তাজমহল দেখেছে, আর এক ভাগে আছে যারা তাজমহল দেখেনি।
প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে কথা বললে, আমার একটি কথা বলতে ইচ্ছা করছে তুমি [শমী কায়সার] তো বুঝতে পারছ আমার প্রেম অপূর্ণ। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ তো! কথাটা তো এমন হতে পারত–তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ, চাচা আপনি এত সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখলেন, কিন্তু কোনো নারী কেন আপনাকে গ্রহণ করল না? এমন তো হতে পারে, আমি চেয়েছিলাম আর তোমাদের [নারী] কেউ আমাকে গ্রহণ করেনি।
হেলাল হাফিজ আজীবন কবিতাই লিখে গেছেন। প্রেমে পড়েছেন অসংখ্য নারীর। তার কবিতায় ব্যবহার করা নাম হেলেন, হিরণবালা, সাবিতা মিস্ট্রেস সবই বাস্তবের রমণী। তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
“ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।”
কবি যখন দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত, নিজেকে হারিয়ে যখন তিনি দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ান পাপ-পঙ্কিলতার পথে; তার কবিতার ভাষায়, নারীই তখন তার উদ্ধারের পথ।
“আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই আমার উদ্ধার।”
তাই বলে তিনি যে কেবল সাধারণ প্রেম করে যাবার বন্দনা করে গেছেন, তা নয়। তাই তো তিনি লিখেছেন,
“মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই”
আজীবন করেছেন দুঃখের চাষাবাদ। বেদনাকে করেছেন নিজের বোন। জীবনও তাঁকে হতাশ করেনি। দু’হাতে দুঃখ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে তার জীবন। আর যেখানে দুঃখের কিছুটা কম পড়েছে, সেখানে নিজেই নিজের মত করে দুঃখ বানিয়ে নিয়েছেন। তার ভাষায়, “বেদনা আমার খুব প্রিয়। আমি মনে করি সুখ আমার জন্য অতটা জরুরি নয়। কারণ সুখ শিল্পের জন্যে তেমন কোনো প্রেরণা দেয় বলে আমি মনে করি না। শিল্পের জন্যে জরুরি হচ্ছে বিরহ, বিচ্ছেদ, বেদনা।”
এই বেদনার ফলেই যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে সব অনবদ্য সাহিত্য। এই কষ্টের ফেরিওয়ালা তাই কষ্ট বিলিয়েছেন সারা জীবন। মানুষের ভেতরের বোধকে করেছেন জাগ্রত। কবি বলেন, “এটা এমনই একটা আকালের দেশ, যেখানে নান্দনিক দুঃখ দেওয়ার মানুষের বড্ড অভাব। ফলে কিছু বেদনা, কিছু দুঃখ আমি নিজেই আমার ভেতর তৈরি করে নিয়েছি এবং চেষ্টা করেছি এই বেদনাকে শিল্পে রুপান্তরিত করার।”
এই কষ্ট তিনি ফেরি করেছেন তার ফেরিওয়ালা কবিতায়,
“কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট”
কষ্টকে কতটুকু কাছ থেকে দেখলে, কতটুকু গভীরে গেলে তিনি এমন উপমা দিতে পারেন, “পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট”; ভাবতেই অবাক লাগে। তিনি কষ্টের ফেরি করেছেন কষ্টগুলো নিজের করে নেওয়ার জন্য। বিনিময়ে দিয়েছেন ভালোবাসা আর শুভ্রতা।
“আমার যতো শুভ্রতা সব দেবো,
আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার
সব কালিমা, সব ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো।”
আবার কখনও কখনও কষ্টের ভারে তার দাঁড়িয়ে থাকাও হয়েছে কঠিন।
“কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন-
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।”
হেলাল হাফিজ সম্বন্ধে শুধু একটি কথাই বলা যায়, এমন মায়া ভরা মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন,
“তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!”
“জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।”